প্রিয় শিক্ষার্থীরা আজ আমরা থ্রি বডি প্রবলেম এবং ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট 3 Body Problem and Lagrange point সম্পর্কে জানবো। মহাকাশে বিভিন্ন মিশন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই দুটো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। থ্রি-বডি প্রবলেমের সমাধান খুঁজতে গিয়েই ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টের বিষয়টি সামনে আসে। আজকের আলোচনায় থ্রি-বডি প্রবলেম এবং ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট সম্পর্কে বলা হবে। বিদ্যাশিখি ডট কম এর রকেট সাইন্স বিভাগে স্বাগত।
গাড়ি পার্কিং করার মানে হচ্ছে পারিপার্শ্বিক কিছু স্থাপনার সাপেক্ষে গাড়িটিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখা। হতে পারে আপনার অফিস থেকে ২০ মিটার দূরে কিংবা একটি গাছ থেকে ৫ মিটার দূরে। অর্থাৎ কিছু বস্তু সাপেক্ষে গাড়িটির দূরত্ব অপরিবর্তিত থাকবে এমন কোনো স্থান।
এখন পৃথিবীতে গাড়ি পার্কিং করার ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কিছুই ভাবতে হয় না। কিন্তু আপনাকে যদি বলা হয় কোনো একটি বস্তুকে মহাকাশে পার্কিং করতে হবে, তবে কিন্তু অনেক বিষয় সামনে চলে আসবে। কারণ মহাকাশে কোনো বস্তুই স্থির থাকে না। মহাকাশে প্রত্যেকটি বস্তুই পারিপার্শ্বিক বস্তুর সাপেক্ষে গতিশীল।
এখন পৃথিবীর সাপেক্ষে মহাকাশের পার্কিং স্পট মানে হচ্ছে, ওই স্থানে কোনো বস্তু রাখলে তা পৃথিবীর সাপেক্ষে স্থির থাকবে। আবার বৃহস্পতির সাপেক্ষে মহাকাশে পার্কিং স্পট মানে হচ্ছে, ওই স্থান যেখানে কোনো বস্তু রাখলে তা বৃহস্পতির সাপেক্ষে স্থির থাকবে। মহাকাশের এমন পার্কিং স্পট বা পয়েন্টকে বলা হয় ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট। যেমন কিছুদিন আগে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে এল-টু ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়াও আরো অনেক ধরনের মহাকাশযান বিভিন্ন ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে পাঠানো হয়েছে।
Table of Contents
Toggleনিউটনের মহাকর্ষ সূত্র (Newton’s law of gravity)

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। এর মাধ্যমে মহাজাগতিক বস্তুর আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন, কেন পৃথিবীতে থাকা কোনো একটি বস্তু মাটিতে পড়ে কিংবা কেন সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরে। প্রথমে নিউটনের মহাকর্ষ তথ্যকে সার্বজনীন মনে করা হয়েছিল, যদিও সেই তথ্য কিছু কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করতে পারছিল না।
পরবর্তীতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব মহাজাগতিক বস্তুর আচরণ সবচেয়ে নিখুঁত এবং নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়। তবে, আলোর বেগের সাপেক্ষে কম গতিতে গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে নিউটনের সূত্রই যথেষ্ট। যার ফলে স্যাটেলাইট কিংবা বিভিন্ন মহাকাশযানের ক্ষেত্রে নিউটনের সূত্র ব্যবহার করা হয়।
নিউটনের সূত্র আমাদের বলে, মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণের পরিমাণ দুটি বস্তুর ভর এবং এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করার ফলে পৃথিবীতে কোনো একটি বস্তু ছেড়ে দিলে তা নিচে পড়ে যায়। একইভাবে সূর্য এবং পৃথিবী পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। তাহলে পৃথিবী কেন সূর্যের ওপর আছড়ে পড়ে না? সর্বোপরি, কেন মহাজাগতিক বস্তুগুলো ভারী বস্তুর চারপাশে ঘোরে?
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে “বেগ”। আমরা যখন একটি ভারী বস্তুকে রশি দিয়ে বেঁধে ঘোরাতে থাকি, তখন ভারী বস্তুটি বাইরের দিকে প্রচণ্ড বল অনুভব করে। এজন্যই ঘোরানোর সময় বস্তুটিকে ছেড়ে দিলে তা অনেক দূরে আছড়ে পড়ে। বস্তুকে ঘোরানোর ফলে বস্তুটি বাইরের দিকে যে বল অনুভব করে, একে বলা হয় কেন্দ্রবিমুখী বল।
বস্তুটি কতটা কেন্দ্রবিমুখী বল অনুভব করবে, তা নির্ভর করে বস্তুটিকে কত বেগে ঘোরানো হচ্ছে তার ওপর। বেগ বেশি হলে বস্তুটি বেশি কেন্দ্রবিমুখী বল অনুভব করবে। এখন এই বিষয়টি সূর্য এবং পৃথিবীর ক্ষেত্রে চিন্তা করুন। সূর্য এবং পৃথিবীর আকর্ষণের ফলে এরা কাছাকাছি আসতে চায়, কিন্তু আবার একই সাথে পৃথিবীর বেগের কারণে পৃথিবী বাইরের দিকে কেন্দ্রবিমুখী বল অনুভব করে। অর্থাৎ মহাকর্ষ বলের কারণে কাছে আসতে চায়, আবার কেন্দ্রবিমুখী বলের কারণে দূরে সরে যায়।
এই দুটি বলের সমতার ফলে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরতে থাকে। এই জন্যই সূর্যের কাছাকাছি থাকা গ্রহগুলোর বেগ বেশি এবং দূরে থাকা গ্রহগুলোর বেগ কম। সূর্যের কাছে থাকা মানে হচ্ছে সেটি বেশি মহাকর্ষ বল অনুভব করবে এবং এই বেশি মহাকর্ষ বলকে ক্যান্সেল করার জন্য বেশি কেন্দ্রবিমুখী বলের প্রয়োজন। এই বেশি কেন্দ্রবিমুখী বল আসবে বেগ থেকে, যার ফলে সূর্যের কাছাকাছি থাকা গ্রহগুলোর বেগ বেশি হয়।
এখন, আমরা যদি শুধুমাত্র দুটি বস্তু বিবেচনা করি, তবে তাদের গতিপথ কেমন হবে তা নিখুঁতভাবে বলা সম্ভব। এমনকি পরবর্তী হাজার বছর পর বস্তু দুটির অবস্থান কেমন হবে, তাও বলে দেওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুনঃ DeepSeek (ডিপসিক) শক্তিশালী হয়ে উঠার গল্প
থ্রি-বডি প্রবলেম (3 body problem)
কিন্তু যখনই দুটি বস্তুর পরিবর্তে তিনটি বস্তু বিবেচনা করা হয়, তখন আর তাদের গতিপথ কেমন হবে তা পূর্বানুমান করা যায় না। একেই বলা হয় থ্রি-বডি প্রবলেম।

নিউটন তার মহাকর্ষ সূত্র দেওয়ার পরেই থ্রি-বডি প্রবলেমের বিষয়টি সামনে আসে। থ্রি-বডির ক্ষেত্রে দেখা যায়, এর জন্য কোনো এনালিটিক্যাল সমাধান নেই। অর্থাৎ সূত্রের মাধ্যমে অঙ্ক কষে দীর্ঘ সময় পরের অবস্থা বা গতিপথ নির্ধারণ করা যায় না। তিন বা তার বেশি সংখ্যক বস্তুর কোনো একটি সিস্টেম বস্তুগুলোর প্রাথমিক অবস্থার ওপর অতিমাত্রায় সংবেদনশীল, অর্থাৎ “সেন্সিটিভ ডিপেন্ডেন্স অন ইনিশিয়াল কন্ডিশন”।
তিনটি বস্তুর প্রাথমিক অবস্থা যেমন অবস্থান, ভর, বেগ এগুলো যদি শতভাগ নিখুঁতভাবে জানা না থাকে, তবে সিস্টেমটির সুদূর ভবিষ্যতের অবস্থা কেমন হবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এক্ষেত্রে সিস্টেমটি বিশৃঙ্খল বা ক্যাওসের দিকে চলে যায়।
যেমন, মনে করুন দুটি ডাবল পেন্ডুলাম আপাতদৃষ্টিতে একই অবস্থান থেকে শুরু করলেও কিছু সময় পর তাদের অবস্থান একরকম পাওয়া যাবে না। কারণ এখানে দুটি পেন্ডুলামের প্রাথমিক অবস্থা একই মনে হলেও সামান্য এদিক-সেদিক থাকলেই ভবিষ্যতের অবস্থা ভিন্ন হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থার ওপর অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতা থাকে।
এখানে অবশ্য তিনটি বস্তুর স্থলে পাঁচটি বস্তু হতে পারে, ছয়টিও হতে পারে, এমনকি যে কোনো সংখ্যক বস্তু হতে পারে। অর্থাৎ বিষয়টি মূলত এন-বডি প্রবলেম।
এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, যদি থ্রি-বডির ক্ষেত্রে নিশ্চিত পূর্বানুমান করা সম্ভব না হয়, তবে সৌরজগতে থাকা গ্রহগুলোর ভবিষ্যৎ অবস্থা কেমন হবে বা কেমন হতে পারে তা কীভাবে নির্ধারণ করা হয়?
আসলে, প্রথম যখন থ্রি-বডি প্রবলেম সামনে আসে, তখন কম্পিউটার ছিল না। ফলে সব ধরনের গণনা মানুষকে হাতে করতে হতো, তাই এন-বডি সিস্টেমের ক্ষেত্রে পূর্বানুমান করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের কাছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার রয়েছে।
যা সেকেন্ডে কোটি কোটি ক্যালকুলেশন করতে পারে। ফলে কোনো একটি সিস্টেমের প্রতিমুহূর্ত স্টেপ বাই স্টেপ ক্যালকুলেশন করে নিকট ভবিষ্যতের মোটামুটি একটি নির্ভুল পূর্বানুমান করা যায়।
নিউটনের সূত্রের মাধ্যমে থ্রি-বডি প্রবলেম সামনে আসার পর অনেক গণিতবিদ থ্রি-বডির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বিশ্লেষণাত্মক সমাধান রয়েছে কিনা তা খোঁজার চেষ্টা করেন এবং এর ধারাবাহিকতায় সামনে আসে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট।
দেখা যায় যে তিনটি বস্তুর কোনো একটি সিস্টেমে তৃতীয় বস্তুটির ভর যদি প্রায় ০ বিবেচনা করা হয়, তবে ত্রিবস্তুর ক্ষেত্রে বিশ্লেষণাত্মক সমাধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে সিস্টেমটি ক্যাওসের দিকে ধাবিত হয় না।
দুটি বস্তুর সিস্টেমে যদি প্রায় ০ ভরের তৃতীয় একটি বস্তুকে কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্টে স্থাপন করা হয়, তবে তৃতীয় বস্তুটির অবস্থান বাকি দুটি বস্তুর সাপেক্ষে স্থির থাকে। আর যে নির্দিষ্ট পয়েন্টের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে, সেই পয়েন্টগুলোকে বলা হয় ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট।
আরও পড়ুনঃ চায়ের দোকানে ব্যবহৃত কিছু ইংরেজি শব্দ, উচ্চারণ, সমার্থক
ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট (Lagrange points)
যেকোনো দুটি বস্তুর একটি সিস্টেম বিবেচনা করলে সেখানে মোট পাঁচটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট থাকে। এর মধ্যে প্রথম তিনটি পয়েন্ট— এল১, এল২ এবং এল৩— চিহ্নিত করেন গণিতবিদ লিওনার্দ ওউলার ১৭৫০ সালে। পরবর্তীতে জোসেফ লুই ল্যাগ্রাঞ্জ বাকি দুটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট চিহ্নিত করেন।

পাঁচটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টের মধ্যে এল১, এল২ এবং এল৩ একই সরলরেখায় অবস্থান করে এবং বাকি এল৪ এবং এল৫ প্রথম দুটি বস্তুর সাথে ৬০° কোণে অবস্থান করে।
এখন, এই ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টগুলোতে কোনো একটি বস্তু কেন আপেক্ষিকভাবে স্থির থাকে, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
আমরা জানি, কোনো বস্তু সূর্যের যত কাছ থেকে প্রদক্ষিণ করে, তার গতি তত বেশি হয়। এখন এল১ পয়েন্ট পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের কাছে অবস্থিত। ফলে এই স্থানে কোনো বস্তুকে যথাযথ বেগসহ রাখলে তা পৃথিবীর তুলনায় দ্রুত সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার কথা।
এল১ পয়েন্টের দূরত্ব পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫০,০০০০ কিলোমিটার। এখন খেয়াল করুন, এল১-এ থাকা বস্তুর ওপর সূর্য এবং পৃথিবী—এই দুটি বস্তুরই মহাকর্ষ বল কাজ করে এবং তা বিপরীতমুখী হয়।
এখন, এল১-এ থাকা বস্তু সূর্যের কারণে যে মহাকর্ষ অনুভব করার কথা, তা থেকে কিছুটা কম অনুভব করবে, কারণ পৃথিবীর মহাকর্ষ এটি বিপরীত দিকে টানবে। অর্থাৎ, এল১-এ থাকা বস্তুটি পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে কম মহাকর্ষীয় বল অনুভব করবে। ফলে এটি পৃথিবীর সমান কৌণিক বেগে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে এবং পৃথিবীর সাপেক্ষে স্থির থাকবে।
এল২-এর ক্ষেত্রে এল১-এর সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা ঘটে। এল২ পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫০,০০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, তবে তা পৃথিবী থেকে সূর্যের বিপরীত দিকে। এল২-তে থাকা বস্তু সূর্য থেকে পৃথিবীর তুলনায় আরও দূরে অবস্থান করায় তুলনামূলক কম মহাকর্ষ অনুভব করার কথা। ফলে এটি সূর্যকে এক বছরে একবারের বেশি সময়ে প্রদক্ষিণ করার কথা।
কিন্তু এল২-এর ক্ষেত্রে সূর্য এবং পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বল একই দিকে কাজ করে। ফলে এল২-তে থাকা বস্তু সূর্য থেকে দূরে থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর সমান মহাকর্ষ অনুভব করে। অর্থাৎ, সূর্যের কারণে পৃথিবী যে মহাকর্ষ অনুভব করে, একই মহাকর্ষ এল২-তে থাকা বস্তুটিও অনুভব করে। ফলে এটি পৃথিবীর সমান কৌণিক বেগে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে।
এল৩ পৃথিবীর কক্ষপথে সূর্যের বিপরীত পাশে থাকলেও এটি পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে প্রায় ২৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখন, এল৩ কিছুটা দূরে হলেও সূর্য এবং পৃথিবীর সম্মিলিত মহাকর্ষীয় বল এর ওপর কাজ করে। ফলে এল৩-তে থাকা বস্তু পৃথিবী-সূর্যের প্রভাবে যে মহাকর্ষ অনুভব করে, একই মহাকর্ষ অনুভব করবে, যার ফলে এটি এক বছরে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করবে।
এল৪ এবং এল৫-এর মেকানিজম একই হলেও শুধুমাত্র এল৪-এর বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
এল৪ পৃথিবী এবং সূর্যের সাপেক্ষে ৬০° কোণে অবস্থান করে। অর্থাৎ, পৃথিবী, সূর্য এবং এল৪-কে সংযুক্ত করলে তা একটি সমবাহু ত্রিভুজ তৈরি করবে।
এখন খেয়াল করুন, এল৪ পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে কিছুটা উপরে অবস্থিত এবং এটি প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে। এর মানে, এল৪-এ থাকা বস্তু পৃথিবীর তুলনায় কিছুটা ধীরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার কথা।
তবে ভারী কেন্দ্রের (বেরি সেন্টার) বিষয়টি সামনে এলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আপনারা যারা আমার বেরি সেন্টারের ভিডিওটি দেখেছেন, তারা জানেন যে পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না, বরং সূর্য এবং পৃথিবী তাদের কেন্দ্রীয় ভারবিন্দুকে (সেন্টার অব মাস) প্রদক্ষিণ করে।
সূর্য এবং পৃথিবীর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভারবিন্দু সূর্যের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখন, এল৪-এ থাকা বস্তু সূর্য এবং পৃথিবীর মহাকর্ষীয় প্রভাবে ভারী কেন্দ্র বরাবর মহাকর্ষীয় বল অনুভব করে এবং তা সূর্যের কারণে পৃথিবীর ওপর যে মহাকর্ষীয় বল কাজ করে, তার সমান হয়।
ফলে এল৪ কিংবা এল৫-এ থাকা বস্তু পৃথিবীর সমান সময়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
পাঁচটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টের ক্ষেত্রে আমরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি—এই পয়েন্টগুলো সূর্য এবং পৃথিবীর দূরত্বের তুলনায় সূর্যের কাছে কিংবা দূরে থাকলেও, সূর্যের কারণে পৃথিবী যে মহাকর্ষীয় বল অনুভব করে, একই বল ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে থাকা বস্তুগুলো অনুভব করে। ফলে সেগুলো পৃথিবীর সমান সময়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং পৃথিবী ও সূর্যের সাপেক্ষে স্থির থাকে। তবে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট শুধুমাত্র সূর্য এবং পৃথিবীর ক্ষেত্রেই থাকে না।
আরও পড়ুনঃ এমপিও শিক্ষকদের ইএফটি তথ্য হালনাগাদ এর সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি
ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টের স্ট্যাবিলিটি (Stability of Lagrange Points)

যেকোনো দুটি মহাজাগতিক বস্তুর ক্ষেত্রে পাঁচটি করে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট থাকে। যেমন, পৃথিবী এবং চাঁদের ক্ষেত্রেও পাঁচটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট রয়েছে। আবার, সূর্য এবং বৃহস্পতির ক্ষেত্রেও পাঁচটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট রয়েছে।
এখন, যেহেতু সূর্য এবং বৃহস্পতির ভর অনেক বেশি, ফলে দুইটি সিস্টেমের এলফোর এবং এলফাইভ পয়েন্টে প্রচুর পরিমাণে অ্যাস্টেরয়েড আটকে থাকতে দেখা যায়, যাদেরকে বলা হয় ট্রোজান অ্যাস্টেরয়েড।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার—ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টের স্ট্যাবিলিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর উপর নির্ভর করে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টগুলোকে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। এলওয়ান, এলটু এবং এলথ্রি হচ্ছে মেটাস্ট্যাবল, অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে আনস্টেবল। কারণ এই পয়েন্টগুলো খুবই সেনসিটিভ, পয়েন্ট থেকে বস্তুটি সামান্য এদিক-সেদিক হলেই বস্তুটি আর প্রদক্ষিণের সময় ঠিক রাখতে পারে না, অর্থাৎ অপর দুটি বস্তুর সাপেক্ষে স্থির থাকে না।
অন্যদিকে, এলফোর এবং এলফাইভ এই দুইটি স্ট্যাবল, অর্থাৎ এই পয়েন্টগুলোতে বস্তু রাখলে বস্তুগুলো সহজে স্ট্যাবিলিটি হারায় না। অবশ্য এই ক্ষেত্রে কোরিওলিস ফোর্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টের স্ট্যাবিলিটি বিষয়টি কেমন তা ভালোভাবে অনুভব করার জন্য স্পেসকে ফেব্রিক বা কাপড়ের মতো বিবেচনা করুন।
এখন ভারী বস্তুর ফলে সৃষ্টি গ্রাভিটি ফোর্সের কারণে ফেব্রিক ভেতরের দিকে বেঁকে যাবে। অন্যদিকে, আবার কেন্দ্রবিমুখী বল এটিও এক ধরনের ফোর্স, যার জন্য ফেব্রিক বাইরের দিকে বেঁকে যাবে। যার ফলে আমরা এমন একটি চিত্র পাবো।
এখন এলওয়ানের ক্ষেত্রে খেয়াল করুন, এখানে কোন একটি বস্তু রাখা মানে হচ্ছে কোন একটি বক্রতলে মার্বেলকে ব্যালেন্স করা। যা থিওরেটিক্যালি সম্ভব হলেও বাস্তবে খুবই কঠিন। একই অবস্থা এলটু এবং এলথ্রির, যার ফলে এলওয়ান, এলটু এবং এলথ্রি মেটাস্ট্যাবল।
অন্যদিকে, এলফোর এবং এলফাইভ পয়েন্টে বস্তুকে স্ট্যাবল রাখার জন্য তুলনামূলক বেশি স্পেস পাওয়া যায়, অর্থাৎ সেখানে বেশি সমতল জায়গা রয়েছে। যার ফলে এলফোর এবং এলফাইভ স্ট্যাবল। সেইসাথে এই দুই ক্ষেত্রে কোরিওলিস ফোর্স কাজ করে, যার ফলে এই ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন যে একটি বোলের মধ্যে মার্বেল রাখা। যার ফলে মার্বেলটি চাইলেও ওই বোল থেকে সহজে বের হতে পারে না, এবং এজন্যই এলফোর এবং এলফাইভ খুবই স্ট্যাবল।
তবে এলফোর এবং এলফাইভ যে সকল ক্ষেত্রেই স্ট্যাবল থাকবে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। এলফোর এবং এলফাইভ স্ট্যাবল থাকবে কিনা তা নির্ভর করে মেজর দুইটি বস্তুর ভরের উপর। মেজর দুটি বস্তুর ভরের অনুপাত যদি ১:২৪.৯৬ বা তার চেয়ে বেশি থাকে, সেক্ষেত্রে ওই সিস্টেমে যে এলফোর এবং এলফাইভ তৈরি হবে, এগুলো খুবই স্ট্যাবল হবে।
এই অনুপাতের চেয়ে কম ভরের দুটি বস্তুর ক্ষেত্রে যে এলফোর এবং এলফাইভ তৈরি হবে, সেগুলো স্ট্যাবল হবে না। সূর্য এবং বৃহস্পতির ভরের অনুপাত ১:১০৪৭.৮, যার ফলে এদের এলফোর এবং এলফাইভ খুবই স্ট্যাবল। এবং এইজন্য এই দুই পয়েন্টে প্রচুর পরিমাণে অ্যাস্টেরয়েড আটকে থাকতে দেখা যায়।
আবার, পৃথিবী এবং চাঁদের ভরের অনুপাত ১:৮১, যার ফলে পৃথিবী এবং চাঁদের এলফোর এবং এলফাইভ পয়েন্টও কিন্তু স্ট্যাবল। যার ফলাফল হিসেবে এই দুইটি পয়েন্টে স্পেস স্টেশন স্থাপন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা রয়েছে।
ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টগুলো পার্কিং স্পটের মত কাজ করার ফলে বিভিন্নভাবে এই পয়েন্টগুলো ব্যবহার করা হয়। এখন পর্যন্ত অনেক স্পেস মিশন এই ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টগুলোতে পরিচালিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে।
পরবর্তীতে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টে পরিচালিত মিশন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলবো। মানবসভ্যতার সবচেয়ে ছোট সময় একক হচ্ছে অ্যাটোসেকেন্ড, যা নিয়ে গবেষণা করে তিনজন ব্যক্তি নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছেন। অ্যাটোসেকেন্ড সাইন্স ইলেকট্রনিক্স বোঝার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
ক্রেডিট: আর্টিকেল এর তথ্যগুলো বিভিন্ন অনলাইন সোর্স থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান পাইসি ইউটিউব চ্যানেল থেকে। বিদ্যাশিখি ডট কম এর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা।
তথ্যসূত্র: বিজ্ঞান পাইসি ইউটিউব (https://www.youtube.com/watch?v=WwwVWAHi8io)
Comments